বাঙ্গালির কথাবার্তায় অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে বাংলা গদ্যরীতি ব্যবহৃত হলেও সাহিত্যে তার অভিষেক ঘটে উনিশ শতকে। এর লিখিত রূপ চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, ক্রিষ্টানদের ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের সীমায় আবদ্ধ ছিল। ১৫৫৫ সালে আসামরাজকে লেখা কোচবিহারের রাজার একটি পত্রকে বাংলা গদ্যের প্রাপ্ত প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করা হয়। ষোল শতক থেকে গদ্যরীতির সুচনা হলেও উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় নিতান্ত প্রয়োজনের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে ভাষাগত দিক থেকে গদ্যের উৎকর্ষসাধন সম্ভব হয়নি।
ড. সুকুমার সেন বাংলা গদ্যরীতির ৪টি স্তর নির্দেশ করেছেন। সেই স্তরগুলোর পরিধি কাল নিচে দেয়া হলো-
প্রথম স্তরঃ ষোল শতক থেকে ১৮০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত
দ্বিতীয় স্তরঃ ১৮০০ সাল থেকে ১৮৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত
তৃতীয় স্তরঃ ১৮৪৮ সাল থেকে ১৮৬৫ সাথের পূর্ব পর্যন্ত
চতুর্থ স্তরঃ ১৮৬৫ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত
আধুনিক যুগকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। । ১৮০০-১৮৬০ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায় এবং ১৮৬১ সাল থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
দোম এন্টোনিও দ্যা রোজারিও রচিত ‘ব্রাহ্মণ সমাজ ক্যথলিক সংবাদ’ বাংলা গদ্যের প্রাথমিক সূচনা। এটি বাঙ্গালির লেখা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। গ্রন্থটি রোমান হরফে পর্তুগালের লিসবন থেকে মুদ্রিত হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামানের ‘পুরনো বাংলা গদ্য’ গ্রন্থে সুদূর ষোল শতক থেকেই গদ্যের ঐতিহ্যের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
ষোল শতকে বৈষ্ণব মহাজনেরা গৌড়ীয় ধর্ম প্রচারে গদ্যের ব্যবহার করেছেন। ধর্মীয় বিষয়বস্তু অবলম্বনে গদ্যের বিচিত্র বিকাশের এই ধারাটি পরবর্তী পর্যায়ে খ্রিষ্টীয় ধর্মসাধকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
বিভিন্ন পত্রে ও অনুশাসনে বাংলা গদ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় শাসকদের মধ্যে পত্র আদান-প্রদান, ব্যক্তিগত পত্র, ফর্দ, দলিল, চুক্তিপত্র, আরজি ইত্যাদির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। নেপালে পাওয়া কিছু নাটকে বাংলা ভাষার নিদর্শন দেখা যায়।
ইংরেজি শাসনের সূত্রপাতে বাংলা গদ্যের ধারাবাহিক চর্চার পূর্বে পুরোনো গদ্য নিতান্ত অবহেলার বিষয় ছিল না। ড. গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘আঠারো শতকের গদ্যঃ ইতিহাস ও সংকলন’ গ্রন্থে বলেন- “অষ্টাদশ শতকে বাংলা গদ্যের যথেষ্ট বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কয়েকজন মুন্সী মিলে রাতারাতি একটি গদ্যরীতির জন্ম দিতে পারেননি। তার জন্য দীর্ঘদিনের অনুশীলন দরকার ছিল”।
কৃপারশাস্ত্রের অর্থভেদ- বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। রচয়িতা পর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্যা আসুসুম্পসাও। রচনাকাল ১৭৩৪ এবং মুদ্রণকাল ১৭৪৩ সাল। পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে এটি মুদ্রিত হয়। এটি বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বিশ্লেষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। এতে প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে রচিত গদ্যের প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। এটি বাংলা ভাষায় রচিত খ্রিষ্ট ধর্মবিষয়ক আদি গ্রন্থ। দুই শতাধিক বছর পূর্বের ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চলের ভাষার কিঞ্চিৎ মিশ্রিত সাধু ভাষায় এটি রচিত হয়েছে।